বসন্তের শেষ দিকে কোন এক দিন। স্কুল থেকে ফিরে বইগুলো কেবলমাত্র বুবুর হাতে তুলে দিই। অমনি পেছন থেকে ডাক আসে- 'কিরে রাহুল, আইজো কি যাইবি না? তুই না গেলে কিন্তু ঐ পাড়ার সুজন বাইরে লইয়াই যামু।'
শিমুলের কথা শেষে আমার আর জবাব দেয়াটা হয় না। আমার মুখ চেপে ধরে শিমুলের উদ্দেশে বুবু বলেন- 'তোর যাকে খুশি নিয়ে যা, ও স্কুল থেকে ফিরেছে এখন ভাত খাবে।'
বুবুর কথা কর্ণপাত না করে শিমুল আমার মুখের দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় আমি তাকে বারান্দার সামনে দাঁড়াতে বলি। কিন্তু আমার ইশারা যে তার মাথায় বিন্দুমাত্র খেলা করেনি, গোমরা মুখে তার চলে যাওয়া দেখেই সেটা বুঝতে পারি। সে চোখের আড়াল হলে বুবু আমাকে হাতের মুঠোয় বন্দী করে পুকুর ঘাটে নিয়ে যান। হাত-পা ধুয়ে দিয়ে বলেন- '‘পারলে পড়ার টেবিলে বসে থাকবি, না পারলে বারান্দার সামনে খেলবি। এর বাইরে কিছু হলেই তর কপালে খারাপি আছে।'
আমার মনে কিছুটা স্বস্তি আসে। অন্তত ঘুমাতে যে বলেনি এটাই আজকের জন্য মঙ্গল। সাহস করে বলি- 'আমি তো বারান্দার সামনেই খেলি। দুরে কোথাও যেতে দেখছো কোনো দিন?'
বুবু আর কিছু না বলে আমাকে নিয়ে ঘরে যান। আমি কীভাবে শিমুলের কাছে যেতে পারি, তা নিয়ে ভাবনাগুলোকে মাথায় গোল্লাছুট খেলতে পাঠাই। সেই খেলার মধ্যেই দ্রুত ভাত খাওয়ার পর্বটা সারি। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াতেই মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। বুদ্ধির চাপ সামলাতে না পেরে বোকার মতো নিজেই হাসতে থাকি। হাসির নমুনা দেখে বুবুতো রেগে আগুন। খপ করে হাত দুটো ধরে বলেন- 'হাসলি ক্যান? ওই আমাকে ফাঁকি দিবি?'
আমার হাসি আরো বেড়ে যায়। হাসি কন্ট্রোলের জন্য ঠোঁট দুটো মিলিয়ে রাখতে যতোই চেষ্টা করি, ততোই ফস করে বিকট শব্দে হাসি বের হয়। তা দেখে বুবু বলেন- 'তুই না সব সময় বলিস মনে চালাকি ঢুকলে হাসি আটকে রাখতে পারিস না। এবার বল কী চালাকি করেছিস।'
আমি বুঝতে পারি গল্প একটা না বানালে আর রক্ষা নেই। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সত্য ঘটনাই বলি- 'বুবু আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। কাল রাতে যে পড়েছিলাম আয়োডিনের অভাবে কী রোগ হয়? ক্লাসে আমেনা ম্যাডাম সেই প্রশ্নটা করলে পাশের বাড়ির নাহিদ কী বলে জানো, লন্ডগন্ড রোগ হয়!'
একথা অনেকটাই কাজে লাগে। আমার হাত ছেড়ে বুবু নিজের হাসি সামলাতে থাকেন। আমি ধীরে ধীরে এক-দুই-তিন পা করে পিছিয়ে যেতে থাকি। বুবু বলেন- 'দুরে কোথাও যাবি না কিন্তু........।'
'আচ্ছা, যাব না। তবে কেউ যেন বারান্দার সামনে থেকে আমাদের তাড়িয়ে না দেয়.......।'
কথাটা বলে আমি বারান্দার সামনে চলে যাই। সেখানে মুক্তা, ফাহাদ, রুবি, ছালমা, লিপি আর সফিসহ অনেকে দাড়িয়াবান্ধা খেলায় মগ্ন। কীভাবে আমার প্যাচে তাদের আটকানো যায়, তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবি। তারপর নেতার মতো হুঙ্কার ছেড়ে সবার উদ্দেশে বলি- 'ওই তোদের প্রত্যেককে যদি একটা করে চকলেট দেই, তোরা আমার কথা শুনবি?'
হ্যা... হ্যা... বলে সবাই চিৎকার দিয়ে ওঠে। খেলায় ছন্দপতন ঘটিয়ে সামনে এসে জড়ো হয়। আমি বুঝতে পারি এবার বুদ্ধিটা প্রয়োগ করা যাবে। তাদেরকে অপেক্ষায় রেখে আমার স্কুলব্যাগ থেকে চকলেটগুলো নিয়ে আসি। যেগুলো দিন কয়েক পূর্বে শেফালি ফুফুর গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কুড়িয়ে পাই। তারপর চকলেট হাতে নিয়ে বলি- 'আমি একজনকে চকলেট দিব, আর তোরা সবাই যতো জোরে পারিস হুররররে..... বলে চিৎকার দিবি। এভাবে প্রত্যেককে দেয়ার সময় চিৎকার দিতে হবে। চিৎকার না দিয়ে যদি কেউ চকলেট খাওয়ার ধান্দা করিস, পেট খারাপ হলে কিন্তু আমার দোষ দিতে পারবি না।'
সবাই নীরব হয়ে যায়। নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে বড় যে, সবার আগে তার হাতেই একটা চকলেট তুলে দেই। আর প্রথম বারের চিৎকারেই আমার কানের বারোটা বেজে যায়। বাধ্য হয়ে চকলেট বিতরণের ভার সফির হাতে তুলে দেই। আর আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। মিনিট কয়েক পরেই বুবু দৌড়ে এসে বলেন- 'ওই, ওই তোরা পালা। দাদা আসছে লাঠি নিয়ে। মনে হয় তোদের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় খুব রেগেছে।'
একথার পর কার সাধ্য আছে দাঁড়িয়ে থাকার? যে যার মতো পালাতে থাকে। আমি সফির হাত ধরে দেই ভো......... দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে বিলের মধ্যখানে গিয়ে থামি। কিছুক্ষণ দম নেয়ার পর একগাল হেসে বলি- 'দে, তোরটা রেখে বাকিগুলো দে। ভালোই হলো। বুবুর সীমানা পেরিয়ে আসতে পারলাম।'
কথার রহস্য বুঝে উঠতে না পেরে সফি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। তারপর চকলেটগুলো হাতে দিয়ে বলে- 'এতগুলান চকলেট তুই এমনে এমনে দিলি?'
'‘ধুর, এমনে এমনে কোথায়? চিল্লানির বিনিময়ে না দিলাম। চকলেট গেল তোরটাসহ সাতটা। কিন্তু আমার তো কাজ হয়েছে অনেক।'
সফি জানতে চায়- 'কিয়ের কাজ?'
আমি আর কিছু বলি না। বুঝতে পারলে সে যে বুবুকে বলে দিবে না, তার ভরসা নাই। পূর্বেও অনেক ঘটনা তাকে বলেছি। তার সমস্যা হলো- কথা সহজে হজম করতে পারে না। গিলে খায় আর সময়মতো জাবর কাটে। তারপর যত বিপদ আমার। সন্ধ্যার পর বই নিয়ে বসলেই বুবুর সৃষ্ট টর্ণেডো ঘাড়ের উপর আঘাত হানে। পরের দিন সফিকে শক্তহাতে ধরলে তোতলামি করতে করতে বলে- 'তু...তু...তুই চে... এইতা যাস ক্যান? আ..আ...আ...আমি তো আর মিছা কই নাই।'
বন্ধু বলে সফিকে বেশি কিছুও করতে পারি না। অথচ মনের দুষ্টুমিগুলো তাকে না বললেও আমার ভালো লাগেনা। কিন্তু আজকের ঘটনা বলা আর কীভাবে সম্ভব? সবাইকে ব্যবহার করে যে স্বয়ং দাদাকেই রাগিয়ে দিয়েছি! সুতরাং জানতে পারলে সবারটা যে আমার ঘাঁড়ে পড়বে না, সেই গ্যারান্টি দিবে কে? এতক্ষণের ঘটনা আড়াল করে পরবর্তী কাজের উদ্দেশ্যে সফিকে বলি- 'তুই যাবি আমার সাথে? শিমুলকে খুঁজে বের করতে হবে।'
'হ্যারে দিয়া কী করবি?'
'কী করি সেটা গেলেই বুঝতে পারবি। আগে চল।'
সফি আর আমি হাটতে থাকি বিলের পাশ দিয়ে বয়ে চলা খালের কিনারা ঘেষে। হাটতে হাটতে বিলের সীমানা পেরিয়ে রাস্তায় উঠি। আমাদের বাড়ি পার হয়ে আরেকটি বিল পেছনে ফেলে দিই। তারপর গন্তব্যস্থল চোখে পড়ে। খাঁন বাড়ির পেছনের বাগানে কেউ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করি। কিছুই নজরে পড়ে না। ধীরে ধীরে যখন বাগানের নিকটবর্তী হই, তখন শিমুলের আওয়াজ শুনতে পাই। তার কাপা কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে- 'ওই... আস্তে কতা কইবি। করিম খাঁয় পুকুর পাড়ে বইয়া রইছে।'
কথাটা শুনে বুঝতে পারি এখানে আসাটা বিফলে যায়নি। আর শিমুলকে না দেখলেও তার অবস্থান বুঝতে অসুবিধা হয়না। কারণ; বহুদিন ধরেই এখানে আসার ডেটিং করে আসছিলাম আমি আর সে। আসা হয়না শুধু আমার কারণে।
বসন্তের শুরুর ঘটনা। পলাশফুল কুড়াতে এসে একদিন নজর পড়ে বাগানের মধ্যখানে মস্তবড় নারিকেল গাছের দিকে। দেখতে পাই নারিকেল গাছের মাথা থেকে কিছুটা নিচে দু’টি গর্ত থেকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে টিয়ে পাখি যায় আর আসে। তখন আমিই গাছে উঠে গর্তে হাত ঢুকিয়ে ডিমের অস্তিত্ব অনুভব করি। সেদিনই শিমুলকে বলে রাখি- 'আমি আর তুই ছাড়া কেউ যেন না জানে। বাচ্চা ফুটলে দুজনে ভাগ করে নিব।'
অবশ্য গর্তে ডিম ছিল তিনটা। তাই সফিকে নিয়ে আসাটা মন্দ হয়নি। তাকে দেখিয়ে শিমুলের কাছ থেকে একটা বাচ্চা আমি বেশিই নিতে পারবো। এখন শিমুল অন্য কোনো ভাগিদার না আনলেই হয়। সফিকে বলি- 'শিমুলের সাথে কেউ না থাকলে তোর কথা বলে আমি একটা বেশি নিব। ভাগ বসানোর জন্য যদি গাছে উঠতে হয় তুই উঠবি তো?'
জবাব না দিয়ে সফি ভয়ে ঢেকুর গিলতে থাকে। আমি তাকে নিয়ে নিঃশব্দে ঝোপের আড়ালে চলে যাই। করিম খাঁয় কোন দিকে তাকিয়ে আছে বুঝার চেষ্টা করি। ওমা! করিম খাঁর নজর দেখি নারিকেল গাছের দিকেই! একবার ঘাঁড় উঁচু করে উপরে, আরেকবার নিচে তাকায়। এখন কি হবে? বুড়ায় নারিকেল চোর বলে চিৎকার দিলে তো সর্বনাশ! টিয়ে পাখির বাচ্চা তো দুরের কথা, মান-ইজ্জত নিয়েই যেতে পারি কিনা সন্দেহ।
তবে পরক্ষণেই মাথায় একটা ধারণা আসে। করিম খাঁর তাকানোর ভঙ্গিই বলে দেয় গাছের নিচে কেউ একজন আছে। সফিকে চুপচাপ বসিয়ে রেখে আমি ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে একটু সামনে এগিয়ে যাই। নারিকেল গাছের গোড়ায় কেউ আছে কিনা দেখার চেষ্টা করি।
হায়... হায়... সর্বনাশ! মাথা না দেখলেও ছয়টা পা স্পষ্ট দেখতে পাই। বুঝতে পারি দু'টো তো দুরের কথা, কপালে একটাও জুটবে না। এটাও বুঝতে পারি, কিছুক্ষণ পূর্বে করিম খাঁয় পুকুর পাড়ে থাকার কথাটা যে শিমুল আমাদের উদ্দেশে বলেনি।
যাক ভালোই হলো। শিমুল আমাদের দু’জনকে দেখেনি। ওই পাহারাদার তিন বলদও অবশ্যই দেখতে পায়নি। যেভাবে হোক তাদেরকে দৌড়ানি দেয়ার একটা ব্যবস্থা করতে পারলেই হয়। সফিকে বলি- 'ওই, তারা চারজনরে। মনে হয় আমার ভাগেরটা হাজার চেষ্টা করেও পাব না। তবে ওদেরকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করলে তোকেও একটা দিতে পারবো, কী বলিস?'
এ কথার পর সফি বলে- 'তারাইবি ক্যামনে?'
আমি ভাবনায় পড়ে যাই। সময়ও খুব কম। ঐদিকে শিমুল অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে। ইশ্, যদি করিম খাঁয় চোর বলে একটা চিৎকার দিতো! ওরা সবাই দৌড়ে পালাতো। তারপর আমি আর সফি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থেকে সন্ধ্যার পর ঠিকই বাচ্চাগুলো গাছ থেকে নামিয়ে নিতে পারতাম। আমার এ ভাবনার মাঝে সফি হঠাৎ বলে উঠে- 'রাহুল একটা বুদ্দি পাইছি।'
'কিসের বুদ্ধি?'
'ওই দ্যাক, ইন্দুরে খাইয়া যেই নাইরকেলডা ফালাইছে, ওইডা লইয়া উপর থিকা মারলে বুড়ায় বুইজা নিবো অরা নাইরকেল চুরি করতাছে। তয় দৌড়ানি দিয়া দিবো।'
আমি বোকা বনে যাই। এ পর্যন্ত বহুবার ওই নারকেলের দেহাবশেষ আমার নজরে পড়েছে। অথচ এ চমৎকার বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। সফিকে মনে মনে ধন্যবাদ দিয়ে বলি- 'হ্যারে, তোর বুদ্ধিটা দারুন হয়েছে। দৌড়ানি খেয়ে সবাই পালিয়ে গেলে আমরা সন্ধ্যার পর দু’জনে মিলে গাছে উঠতে পারব।'
সফি বলে- 'বাই আ.. আ.. আ.. আমি যে গাছে উটতাম জানি না।'
কথাটা শুনে মেজাজটা যার পর নাই এমন চড়া হয়। ধমকের সুরে বলি- 'ধুর'।
অমনি ঘটে মজার কান্ড। আমার 'ধুর' শব্দটা সম্ভবত পাহারাদার তিন বলদের কানে 'ধর' এর মতো লাগে। পরক্ষণেই দেখি তাদের ছয় পা মিনিটে মাইল গুনতে ব্যস্ত। তাদের দৌড়ের নমুনা দেখে শিমুলও তরতর করে গাছ থেকে নেমে দেয় দৌড়। আর ঐ করিম খাঁয় চিৎকার করে বলতে থাকে- 'ঐ ক্যাডারে তোরা? হারামজাদারা দিনদুপুরে নারকেল পারস।'
তারপর যত রকমের আবোল-তাবোল শব্দ উচ্চারণ করতে থাকে। এমন সব উদ্ভট শব্দ, যেগুলো কোনো কালেও বাংলা অভিধানে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। সেই শব্দের আঘাত থেকে বাঁচতে আমি আর সফি কানে আঙ্গুল দিয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাসি মিলিয়ে যায়। কারণ; সামনে মহাবিপদ। যার নাম অপেক্ষা। কখন সন্ধ্যা হবে? কখন সূর্যমামা লুকিয়ে প্রকৃতিকে অন্ধকারে ঢেকে দিবে? দুজনেই একে অপরকে সেই প্রশ্ন করতে থাকি। যদিও জানা আছে- অপেক্ষার প্রহর গুনতে গেলে এক একটি মিনিট যে ঘণ্টার চেয়ে বেশি মনে হয়। তার মধ্যে বাগানের বড় সাইজের মশাগুলো অপেক্ষাটাকে স্মরণীয় করে রাখতে কী যে অত্যাচার শুরু করে, বলে তা বুঝানো সম্ভব নয়। মশার দল আদর দিতে বসলে সজোরে থাপ্পর মেরে যে থেতলে দিবো, সেই সুযোগই বা কোথায়? বুড়া করিম খাঁয় যে আমাদের চৌহদ্দিতে ঘুরোঘুরিতে ব্যস্ত। রাগের মাথায় সফি একবার বলে- 'শালা করিম্মা, ক্যাল ফাকিগুলা নিমু দেইক্কা কিছু করি নাই। নাইলে ফ্যাক মাইরা তরে ভুতখেলা দেখাইতাম।'
যা হোক, ঝোপের মধ্যে বসে থেকে আমি আর সফি অনেকটা সময় পার করে দেই। সূর্যমামা যখন দিন-রাত্রির মিলনস্থলে হাজির, তখনই দেখি করিম খাঁয় আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তা দেখে সফি সেকেন্ডে মাইল গুনতে প্রস্তুতি নেয়। আমি খপ করে তার হাত চেপে ধরি। আর বলি- 'চুপ, দৌড় দিবি না। একটু আগে বুড়ারে শুকনো মাটি হাতে নিতে দেখেছি। হিসি করবে মনে হয়।'
সফি স্থির হয়। করিম খাঁয় আমাদের উপস্থিতি টের পেল কিনা, আমি তা বুঝার চেষ্টা করি। কিছুটা কাছাকাছি এসে বুড়া আমাদের দিকে মুখ করে যখন ধীরে ধীরে কাপড় তুলতে থাকে, তখন বুঝে নিই বুড়ায় যে আমাদেরকে দেখেনি। আর সফি আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে- 'হায়, হায়রে, আইজ না জানি কোন কুফার মুখ দেইখা আইছি।'
আমি কিছু না বলে সফির মুখ চেপে ধরি। তারপর নিজেদের চক্ষুলজ্জা বিসর্জন দেয়া থেকে বাঁচার জন্য দু’জনেই চোখ বন্ধ করে রাখি। কিছুক্ষণ পর সামনে একটা কিছু পড়ার শব্দ শুনে দু’জনেই চোখ খুলি। দেখতে পাই কেঁচোর ঠেলে দেয়া একটি মাটির দলা আমাদের সামনে পড়ে আছে। আর করিম খাঁয় পুকুর ঘাটের দিকে যাচ্ছে। সফি মাটির দলাটা হাতে নিয়ে বলে- 'আমাগো সামনে মনে অয় এইডা ফরছে।'
আমি বুঝে নেই ব্যাপারটা। শালা বুড়ায় ব্যবহারের পর ঢিলটা নিজের অজান্তেই আমাদের দিকে ছুড়ে মেরেছে। সফিকে বলি- 'বেয়াক্কেল, এটা হাতে নিছস ক্যান?'
'হাতে নিছি কি অইছে? এইডা কি খারাপ জিনিস?'
'না, খারাপ না। এটা তোর কপালে পড়লে ভালো হতো। আহাম্মক এটা না বুড়া হিসির পর কাজে লাগিয়েছে।'
'অ্যাহহেরে........ তুই আগে কইবি না।'
মাটির দলাটা বুড়ার দিকে ছুড়ে মারে সফি। যা বুড়ার কয়েক হাত পিছনে গিয়ে পড়ে। তারপর দু’জনে ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে নারিকেল গাছের দিকে এগিয়ে যাই। সামনে আর বাঁধা নেই দেখে একের পর এক হামাগুড়ি দিয়ে আমি গাছে উঠতে থাকি। সফি উঠতে চাইলে বারণ করি। অবশেষে অনেক কষ্টের পর সবগুলো বাচ্চা একসাথে নিয়ে গাছ থেকে নেমে আসি। অভিযান শেষ করে যখন বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াই, তখনই কয়েক জনের গুনগুনানি শুনে চমকে উঠি। আগের মতোই তড়িঘড়ি ঝোপের আড়ালে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করি। পরক্ষণেই শিমুলের কণ্ঠ থেকে শুনতে পাই- 'সুজন ভাই, আপনে চিন্তা কইরেন না। তিনটা ব্যাচতে পারলে আপনে একটার ট্যাকা পাইবেন।'
'নাহ্। আমারে অর্ধেক টাকা দেওন লাগবো।'
কিন্তু শিমুল রাজি হয় না। সে বলে- 'সব কামই ত আমার করন লাগবো। শুধু লগে থাইকা অর্ধেক ভাগ চাইলে ক্যামনে অয়?'
সুজন ভাই আরো শক্ত অবস্থান নেয়। জোর গলায় বলে- 'তোর ব্যাচন লাগবো না। কেডা কিনবো আমারে খালি কইয়া দিবি। বেইচা আমি তোরে অর্ধেক ট্যাকা দিয়া দিমু। এইডা যদি না অয় তুই চইলা যা। সব কাম আমি একলাই করুম।'
শিমুল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে- 'আপনে যদি আমার আর রাহুলের পাখি নেন, খারাপ অইব কিন্তু সুজন বাই।'
'ওই, কতা বেশি কইবি, তয় দিমু একটা।'
সুজন ভাই একথা বলার পর আমি আর সফি একটু নাড়াচাড়া দেই। কিছু একটা না করলে যে এখানে শিমুল মার খাবে, তা নিশ্চিত। সমস্যা কারো চেয়ে কারো কম নয়। শিমুল বেচারা অনেক আগেই বলেছিল টিয়ে পাখির বাচ্চা একটা বিক্রি করে বৈশাখী মেলা থেকে তার ছোট বোনকে পুতুল কিনে দিবে। আর সুজন ভাই তো একটা নেশাখোর। কাজকর্ম না করে সারাদিন শুধু টাকার গন্ধ খোজে। মাঝে মাঝে নেশার টাকা জোগাতে না পারলে পাড়ার পাবলিক টয়লেটের বদনাটাকেও রেহাই দেয় না। এ মুহূর্তে ঠিক কি করলে যে সবার জন্য ভালো হবে, বুঝে উঠতে হিমশিম খাই। সফির দিকে তাকালে সে নারিকেলের দেহাবশেষটি দেখিয়ে দেয়। ওটাই উত্তম সমাধান ভেবে জিনিসটা হাতে নিয়ে কিছুটা দুরে সরে যাই। করিম খাঁর পুকুর পাড়ে নারিকেল গাছ বরাবর পানিতে ছুড়ে মেরে দু'জনে ভো.... দৌড় দেই।
তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারাদের কিঞ্চিৎ আলোয় পথ চিনে নিয়ে আমি আর সফি বাড়ির সীমানায় পা রাখি। টিয়ে পাখির বাচ্চা একটা সফির হাতে দিলে সে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আমি নিঃশব্দে পা চালিয়ে বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর ধীরে ধীরে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে কান পেতে বুবুর রাগটা মাপার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো কিছুই শুনতে পাই না। ততোক্ষণে সফি ঘরে গিয়ে তার মাকে খুঁজে না পেয়ে আমাদের ঘরের পেছনের দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। বুবু ভেতর থেকে রাগান্বিত কণ্ঠে বলেন- 'ওই... ঘরে আজ তর ঠাই হবে না। এতোক্ষণ যেখানে ছিলি সেখানেই চলে যা।'
একথা শুনে ভয়ে আমার অবস্থা যায় যায়। আর সফি বলে- 'রেবা আফা আমি সফি। মায় কি আন্নেগো ধারে আছে?'
বুবু দরজা খুলে সফিকে বলেন- 'নাহ্, তর মা এখানে নেই। তুই কি রাহুলকে দেখেছিস?'
'হ, বারিন্দার সামনে খাড়ায়া রইছে।'
'তর হাতে এটা কি?'
'টিয়া পাখির ছাও। রাহুল আমারে একটা দিয়া, হে দুইডা নিছে। এগুলা আনতে গিয়াই এত দেরি অইছে।'
'সত্যি বলছিস! পাজিটাকে আসতে বল।'
কথাটা শুনে আমি টিয়ে পাখির বাচ্চা দুটো হাতের তালুতে নিয়ে, মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই। বুবু আমার হাত থেকে নিয়ে একটি মাটির পাত্রে খুব সুন্দর বাসা তৈরি করে রেখে দেন। বাচ্চা দুটোর প্রতি বুবুর এতো আগ্রহ দেখে সফি তারটা হারানোর ভয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। তারপর বুবু আমার হাত-পা ধুয়ে দিয়ে হাসিমুখে বলেন- 'অনেক দিন পর একটা কাজের কাজ করেছিস। এবার পড়তে বস।'
আমি বুঝতে পারি আজকের জন্য মামলা থেকে খালাস পেয়ে গেছি। কিন্তু পরক্ষণে যখন মনে পড়ে বুবুর এমন চঞ্চলা হাসিমুখ এই প্রথম দেখলাম, তখন আমার দু'চোখের জল শত চেষ্টার পরও আটকাতে ব্যর্থ হই। বুবুকে ফাঁকি দিয়ে অশ্র“টুকু মুছে বলি- 'বুবু একটা তোমার আর একটা আমার। আমারটার নাম হবে মিঠু। আর তোমারটার নাম মিনা।'
বুবু বলেন- 'নাহ্, আমারটা হবে মিঠু।'
এ নিয়ে দু'জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। অবশেষে বাবা এসে সমাধান দেন। বলেন- 'তাহলে লটারী হোক। যার হাতে যেটা উঠবে সেটাই হবে তার পাখির নাম।'
বুবু মেনে নিলেও বাবার এ লটারী তত্ত্বটা আমি মেনে নিতে পারি না। লটারীতে আমি হেরে গেলে কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু আমার বুবুতো হেরে যেতে পারেন না। কারণ; শিশুকালে মা ডাকটি আমার মুখে ফুটেছিল কিনা মনে নেই। স্মরণ শক্তি বলে দেয়- বুবু ডেকেই আমার দিনের শুরু, আবার বুবু ডেকেই দিনের সমাপ্তি ঘটত। আর মাকে হারানোর পর সেই শিশু রাহুলকে লালন-পালন করে এপর্যন্ত নিয়ে আসতে যিনি হেরে যাননি, তিনি যদি লটারীর কাছে হেরে যান? এমনটি ভেবে বাবাকে বলি- 'না বাবা। লটারী লাগবে না। বুবুরটার নামই মিঠু হোক।'
কী মনে করে যেন বুবুও ভোল পাল্টে বলেন- 'না বাবা। আমারটার নাম মিনাই থাকুক।'
তারপর থেকে মিঠু আর মিনা আমার কৈশোর জীবনের দিনগুলোর চিত্র একেবারেই পাল্টে দেয়। পাখা গজানোর পর প্রায়ই মিঠু আর মিনাকে দুই কাঁধে নিয়ে স্কুলে চলে যাই। মনে পড়ে, প্রাইমারী স্কুলের সর্বশেষ দিনও যে মিঠু আর মিনাকে দেখিয়ে ক্লাসের সব ছাত্রীদের আমার দখলে রাখি। আর ক্লাসের ঠিক কতজন ছাত্রী যে মিঠু আর মিনার প্রেমে পড়ে আমার ব্যাগে চিরকুট লিখে রাখতো, তার সংখ্যাও কোনো দিন হিসেব করে রাখা হয়নি। কৈশোর জীবনের পুরোটা জুড়েই মিঠু আর মিনা ছিল আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
একদিন বিয়ের পর বুবু স্বামীর ঘরে চলে গেলে আমি বড্ড একা হয়ে যাই। আর একা হয়ে গেলেও মিনা আর মিঠু থাকায় নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হয়না কোনো দিন। কয়েক বছরের মাথায় বাবা যখন পুনরায় বিয়ে করেন, তখন পড়ালেখার দোহাই দিয়ে আমাকে শহরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শহরে যাব না বলে হাজার কাকুতি-মিনতি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রচন্ড চাপের মুখে অষ্টম শ্রেণি শেষে মিঠু আর মিনাকে ছেড়ে চলে যেতে হয় শহরে। কতো দিন, কতো বছর পেছনে ফেলে দেই, কিন্তু ভুলতে পারিনা কৈশোর জীবনে হাজারো ঘটনার জন্ম দেয়া সেই মিনা আর মিঠুকে। আমার কৈশোরের একখন্ড স্মৃতি হয়ে থাকা মিনা-মিঠুর ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছিল, তা আজো জানি না। কারো কাছে জানার চেষ্টাও করিনা কোনো দিন।